প্যারেন্টিং ‘মালাকার’

বাগানে গাছের পরিচর্যা করেন যে মালী, তাকে মালীকে দেখবেন যে উনি বাগানের প্রত্যেকটা গাছ সম্পর্কে বিস্তারিত জানেন । কোন গাছের কি অবস্থা উনি খবর রাখেন।

মালী কিন্তু কক্ষনো দু’টি গাছের মধ্যে তুলনা করেন না। আমরা কিন্তু আমাদের বাচ্চাদেরকে তুলনা করি । প্রত্যেকটি বাচ্চার এক-একটি আলাদা আলাদা সত্ত্বা আছে। এই  সত্তাটাকে আমাদের  সম্মান করতে হবে। আমরা কক্ষনো দু’টি বাচ্চার মধ্যে তুলনা করতে পারি না । যেভাবে একজন মালী কক্ষনো দু’টি গাছের মধ্যে তুলনা করেন না, তিনি জানেন কিভাবে অপেক্ষা করতে হয়। সেভাবেই কিন্তু তিনি গাছের পরিচর্যা করেন, নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত কোন ফল আশা না করে।

একজন মালী যেমন তার গাছের প্রকৃতি সম্পর্কে জানেন, সেভাবে একজন মালী প্যারেন্ট তার সন্তানের যোগ্যতা-অযোগ্যতাগুলি সম্পর্কে জানেন। এই ব্যাপারটা তাদের জানতে হয়। নিম গাছের সাথে কি কক্ষনো গোলাপ গাছের তুলনা হয়? একজন মালী কি তুলনা করেন? তেমনি আমাদের বাচ্চারা কেউ গাঁদা ফুলের মত, কেউ গোলাপ ফুলের মত, কেউ বা আবার একেবারেই ক্যাকটাস ফুলের মত।

একজন মালী জানেন যে কোন গাছটায় কখন পানি দিতে হয়, কখন ছায়ায় রাখতে হয়, কোন গাছটার জন্য কোন পরিবেশ ভাল এ কথা সবচেয়ে বেশী একজন মালী জানেন। আমরাই শুধু আমাদের সব সন্তানকে এক রকম ভাবে বড় করতে চাই। এক রকমের শিক্ষা দিয়ে বা একই রকমের আচরণ দিয়ে তাকে লালন-পালন করতে চাই এবং আশা করি যে, সবাই খুব সুন্দর, সুবোধ বাচ্চা হবে। সব বাচ্চা আমাদের সব কথা শুনবে, যা বলি তাই করবে, চুপচাপ থাকবে। কথা বেশিও বলতে পারবে না আবার কমও বলতে পারবে না। আমরা একটা পরিমিতিবোধ তৈরি করে নেই যে আমাদের মনের যেমন ইচ্ছা-আকাঙ্খা, আমাদের বাচ্চা অবিকল সেরকম হবে। কেন?

কখনো ভেবেছেন? আপনার বাচ্চা তো ফ্যাক্টরিতে তৈরি হওয়া কোন প্রোডাক্ট নয় যে সবগুলো একই আকৃতির, একই রকমের হবে? সৃষ্টিকর্তা একেক জনকে, একেক রকম ভাবে পাঠিয়েছেন।

আপনি যদি প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে দেখেন যে, পৃথিবীতে এমন কোন গাছ আছে, যেটা আম গাছের সাথে মিলবে? আবার আপনি যদি শুধু পৃথিবীর সব আম গাছের দিকে লক্ষ্য করেন দেখবেন যে সব আম গাছ ও দেখতে এক রকম না । একটা আম গাছে  লক্ষ লক্ষ পাতা থাকতে পারে। ভাল করে লক্ষ্য করলে দেখবেন যে, সবগুলো পাতা দেখতে কক্ষনো এক নয় । সৃষ্টিকর্তা প্রকৃতি সৃষ্টি করেছেন বৈচিত্রময় করে । এই বিচিত্রতা একটা দারুন জিনিষ । তো আপনি কিভাবে ভাবেন যে সৃষ্টিকর্তা সব মানুষকে একই রকম ভাবে বানাবেন? কক্ষনো এমন হবে না, এরকম হয় না।

পজিটিভ প্যারেন্ট এই জিনিষগুলো জানেন । কোন বাচ্চাকে কীভাবে পরিচর্যা করলে সে ঠিক মত মানুষ হবে সেটাও তারা জানেন।  তারা জানবেন যে তার বাচ্চার ট্যালেন্ট কোন দিকে? এটা তাকেই খুঁজে বের করতে হবে। আমাদের কারো কারো বাচ্চা প্রচুর কথা বলে। ঐ কথা বলার ট্যালেন্ট-টিকে কিভাবে কাজে লাগানো যায়, আপনি সেই বিষয়টাতে মনোনিবেশ করবেন। তাকে কোন পাবলিক স্পিকিং কোর্সে ভর্তি করানো যায়,  গল্প বলার ট্রেনিং-এ ভর্তি করানো যায় । তাকে কথা বলতে উৎসাহ দেওয়া যায়। তার লেখাপড়াগুলো যেন কথা নির্ভর হয়, সে বিষয়ে খেয়াল রাখা যায়। কিন্তু আমরা ঠিক উল্টোটা করি। তার কথা বলাটাকে দোষ হিসাবে ধরে নেই। তাকে কথা বলতে নিরুৎসাহিত করি। একজন মালী কখনও ‘গোলাপ গাছে কাঁটা কেন’ (?!) এরকম কথা

বলে অভিযোগ করেন না। তিনি জানেন, গোলাপ গাছের কাঁটাই সে গাছের সৌন্দর্য।

সুন্দর করে কথা বলা একটি শিল্প এটা আমরা সবাই স্বীকার করি। কিন্তু আমাদের বাচ্চারা যখন কথা বলে আমরা সেটা সহ্য করতে পারি না। আমি আমার একজন ভারতীয় সহপাঠীর কথা আপনাদের সাথে শেয়ার করতে চাই। উনি খুব সুন্দর গুছিয়ে কথা বলতে পারেন। উনার স্টেজ পারফর্মেন্স অসামান্য। যখন উনি স্টেজ পারফর্মেন্স শুরু করলেন তখন উনার বয়স প্রায় আটচল্লিশ। তখন আমাদের  ট্রেইনার উনাকে জিজ্ঞেস করলেন আপনার এত সুন্দর বাচনভঙ্গি, আপনি এত দেরি করে কেন শুরু করলেন। আপনি যদি পাবলিক স্পিকিং এর ফিল্ডে আরো আগে আসতেন, আপনি অনেক ভাল করতেন। এতদিনে আপনি মিলিওনিয়ার হয়ে যেতেন । তখন উনি উনার ছোটবেলার অভিজ্ঞতা শেয়ার করলেন। ছোটবেলায় উনি যখন কথা বলতেন, তখন আশপাশের সবাই উনাকে ‘রেডিও-রেডিও’ বলে ডাকতো। ‘এই রেডিও এখন বন্ধ হয়ে যা, এই রেডিও এখন চ্যানেল চেঞ্জ কর…’ ইত্যাদি। উনার কথা বলাটাকে নিয়ে আশপাশের মানুষজন টিটকারী করতেন। এবং সে জন্য তিনি কথা বলাটা ধীরে ধীরে কমিয়ে দেন, একসময় আর পারতপক্ষে কথাই বলেন না।

আমরা কিন্তু আমাদের বাচ্চাদের এই ট্যালন্টগুলোকে নিরুৎসাহিত করি, এগুলো নষ্ট করি, এগুলো বিকশিত হতে দেই না। পজিটিভ প্যারেন্ট তার বাচ্চার জন্মগত ডিফল্ট ট্যালেন্ট সম্পর্কে অবগত থাকবেন। এবং সেটার পরিচর্যা করবেন ।

অনেক বাচ্চা ছবি আঁকতে পছন্দ করে,তাকে ছবি আঁকার ক্লাসে দিয়ে দিন, আবার অনেকে সাঁতার শিখতে পারে। এতে তার শারীরিক পরিশ্রম হয়। উপকারী হরমোন নিঃসরণ হবে। প্রত্যেকটি বাচ্চাকে সাঁতার শিখনো দরকার। এরকম দু’তিনটা দক্ষতা তার মধ্যে গড়ে তুলতে হবে। ট্যালেন্ট এবং দক্ষতা দু’টি আলাদা জিনিষ । যেমন কোন একটা বাচ্চা কোন একটা বিষয়ে ট্যালেন্ট হতে পারে। সে ট্যালেন্ট-টিকে যদি আমরা দক্ষতায় পরিণত করতে না পারি, তাহলে সেটা কাজে আসে না। যেমন কোন একটা বাচ্চার গানের গলা ভালো। কিন্তু যখন আমরা তাকে গান শিখার ক্লাসে ভর্তি করিয়ে দিব। তখন ধীরে ধীরে তার ট্যালেন্ট দক্ষতায় পরিণত হবে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *